স্বদেশ ডেস্ক:
গত ১০ বছরে বিমানের সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী কমিশনে বিমান থেকে টিকিট নিয়েছেন প্রায় ৪৫ হাজার। এসব টিকিটের মধ্যে রয়েছে আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ রুটের ফ্লাইটও। এর মধ্য দিয়ে বিমান আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কয়েকশ কোটি টাকা বলে মনে করে সংসদীয় কমিটি। এসব কর্মকাণ্ডে বিমানকে বছর বছর লোকসান গুনতে হচ্ছে। বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে দেওয়া নথি পর্যালোচনায় এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
বাংলাদেশ বিমানের উপমহাব্যবস্থাপক তাহেরা খন্দকার আমাদের সময়কে জানান, বিমানের একজন স্থায়ী কর্মকর্তা বছরে দুটো টিকিট ফ্রি পান, তবে ট্যাক্স দিতে হয়। পাশাপাশি একই কর্মকর্তা বছরে আরও ২০টি টিকিট সর্বোচ্চ ৯০ শতাংশ ছাড়ে নিতে পারেন। এসব টিকিট কর্মকর্তারা পরিবারের সদস্যদের দিতে পারেন। উল্লেখ্য, একজন কর্মকর্তা বছরে সর্বোচ্চ দুবার বিদেশে যেতে পারেন।
সংসদীয় কমিটি সূত্র জানায়, বিষয়টি নিয়ে সংসদীয় কমিটিতে আলোচনাকালে কয়েক সদস্য ক্ষোভ প্রকাশ করেন। পূর্ববর্তী বৈঠকে কমিটির সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ বিষয়টি উত্থাপন করেন। পরবর্তী সময়ে কমিটি দশ বছরের টিকিটের হিসাব চান। সংসদীয় কমিটিতে দেওয়া মন্ত্রণালয়ের নথি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বিমানের অর্থ পরিদপ্তর, উচ্চপদস্থ থেকে কনিষ্ঠ কর্মকর্তা সবাই এ সুবিধা নিয়েছেন।
একইভাবে প্রকিউরমেন্ট অ্যান্ড লজিস্টিক সাপোর্ট পরিদপ্তরের পরিচালক মমিনুল নিজ নামের পাশাপাশি স্ত্রী-পরিজনদের নামেও নিয়েছেন একাধিক টিকিট। তিনি এবং তার পরিবার মিলে সুবিধা নিয়েছেন ১০ বছরে ৪৬ টিকিটের। এর কোনোটিতে শতভাগ কমিশন, কোনোটিতে ৯০ ভাগ। একইভাবে প্রকিউরমেন্ট এবং লজিস্টিক শাখার উপব্যবস্থাপকও কম যাননি। তিনি এবং তার পরিবারের নামে নিয়েছেন ১১টি টিকিট।
আর ওই বিভাগের ব্যবস্থাপক বাণিজ্যিক মো. সরোয়ার হোসেন নিয়েছেন ১৩টি টিকিট। এসব টিকিটের কোনোটিতে শতভাগ কমিশন সুবিধা নিয়েছেন। সিনিয়র সাইন রাইটার মোহাম্মদ মহসীন নিয়েছেন ২২টি টিকিট। নিজ, স্ত্রী ও সন্তান রয়েছে এ তালিকায়। সব টিকিট বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। সহব্যবস্থাপক প্রকিউরমেন্ট স্বপন কুমার দে। তিনি অন্য সবাইকে ছাড়িয়ে নিজে এবং পরিবার-পরিজনের নামে কমিশনে টিকিট নিয়েছেন ৬৮টি। তার প্রতিটি টিকিট কমিশনের পরিমাণ শতভাগ। তবে ৯০ শতাংশের কম নয়। সহব্যবস্থাপক মো. নুরুজ্জামান ১২টি, প্রশাসনিক কর্মকর্তা রোকসানা আক্তার ১৮টি, প্রশাসনিক সহকারী দিলরুবা আফরোজা নিজ, স্বামী, ছেলেমেয়ে এবং পিতা-মাতার নামে নিয়েছেন ২৬টি ওয়ানওয়ে টিকিট। আবুল হাসেম ১৭টি, একেএম শাহফুজুর রহমান ১৪টি, মানিকুর রহমান ২টি, লামিয়া শারমিন একাই নিয়েছেন ৫০টি টিকিট সুবিধা। নিজাম উদ্দিন ৮টি, ফকির আবদুল হালিম ৮টি, আবদুল খালেক ১৪টি, আলমগীর কবির ১৮টি, আবু তালেব ১৭টি, গোলাম রসুল ১টি, ইস্টার হালদার ২২টি, সাইফ উদ্দিন ১৬টি, আবদুর রশীফ ১৩টি, ফরহাদুর রেজা ১৮টি, মাছুদুল আলম খান ৬টি, শরীফুল ইসলাম ১৩টি, শরিফ হাসান ১৩টি, হাবিবা মির্জা ২০টি, নেছার আলী গাজী ৪৬টি, জাহাঙ্গীর আলম তোকদার ২০টি, রবিউল ইসলাম ২০টি, মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন ৪টি এবং মতিউর রহমান ৪টি।
এসব কর্মকর্তা-কর্মচারী সবাই প্রকিউরমেন্ট ও লজিস্টিক পরিদপ্তরে কর্মরত ছিলেন। প্রশাসন পরিদপ্তরের কর্মকর্তাদের কেউ নিয়েছেন ২৯টি টিকিট, কেউ ২০টি, কেউ ১৮টি। এর মধ্যে মো. আল মাসুদ খান ও কামাল হোসেন ১৮টি করে টিকিটি নিয়েছেন। ফখরুল আলম চৌধুরী নিয়েছেন ২৯টি। যার প্রতিটি টিকিটে কমিশন ধরা হয়েছে ৯৫ শতাংশ। এ শাখার ৪২ জন কর্মকর্তার সবাই ৯০ থেকে ১০০ ভাগ কমিশন নিয়েছেন টিকিটপ্রতি।
আন্তর্জাতিক পরিভ্রমণে এ জেডএম আরিফ সহকারী ব্যবস্থাপক ও সংগঠন ও পদ্ধতির এ কর্মকর্তা ভারত সফরে ২০১২ ও ১৪ সালেই ২টি টিকিট নিয়েছেন। প্রতিটিতে ৯০ শতাংশ কমিশন নেন। আইটি ডিভিশনের উপব্যবস্থাপক সৈয়দ মোস্তাক হোসেন দেশি-বিদেশি বিভিন্ন রুটে নিজ পরিবারের নামে ৩৩টি টিকিট নিয়েছেন। প্রতিটি টিকিটে কমিশন ৮৫-৯০ শতাংশ। আর আরিফুল হাসান সাধন (সিনিয়র সিস্টেম এনালিস্ট) নিয়েছেন ৮৭টি টিকিট। সব নিজ ছেলেমেয়ে এবং পিতা-মাতাসহ আত্মীয়-পরিজনের নামে। তিনিও ৯০ থেকে ১০০ ভাগ কমিশন নিয়েছেন প্রতিটি টিকিটে। তার পুরো পরিবার গত ১০ বছরে দেশের ভিতরে বিমানে ছাড়া অন্য কোনো যানবাহন ব্যবহার করেনি। নার্গিস আক্তার নিয়েছেন ৪৩টি টিকিট। সব টিকিটে পরিবার-পরিজন সুবিধা নিয়েছে।
এখানেও কমিশন পেয়েছেন ৮৫ থেকে ১০০ ভাগ। এভাবে গত ১০ বছরে বিমানে কর্মরত সব বিভাগের কর্মীরা কমিশনে টিকিট গ্রহণ করেছেন। এতে সরকারের রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে কয়েকশ কোটি টাকা। আগামীতে এসব কমিশনবাণিজ্য বন্ধ করতে বিমান মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ জানিয়েছে। ভাড়ায় আনা এয়ারক্রাফট বসিয়ে রেখে মাসে দিতে হচ্ছে সাড়ে ৫ কোটি টাকা ফ্লাইট চলাচলে গতি আনতে মিসরের ইজিপ্ট এয়ারক্রাফট থেকে বোয়িং ৭৭৭-২০০ ইআর মডেলের এয়ারক্রাফট ভাড়ায় আনে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। ড্রাই লিজে আনা বিমান দুটি বিমানবহরে যুক্ত হয় ২০১৪ সালের মার্চ মাসে। বিমান দুটি কিছুদিন পর অকেজো হয়ে যায়। চুক্তি অনুযায়ী বিমান চলুক আর না চলুক, মিসরে ওই প্রতিষ্ঠানকে প্রতি মাসে সাড়ে ৫ কোটি টাকা দিতে হচ্ছে বিমানকে।
গতকাল অনুষ্ঠিত বৈঠকে উত্থাপিত প্রতিবেদনে এ তথ্য পাওয়া গেছে। বৈঠক শেষে কমিটি সভাপতি র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরীর সাংবাদিকদের বলেন, আমরা একটি সাব-কমিটি গঠন করে দিয়েছি। সেই কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার পর বলতে পারব এয়ারক্রাফট ভাড়ার বিষয়টি। তবে এ ক্ষেত্রে কী ক্ষতি হলো সেটা আমাদের দেখার বিষয় নয়। আমরা দেখব মন্ত্রণালয় কী সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কারা চুক্তি করেছিল। সেটা যথাযথ ছিল কিনা। বৈঠকে জানানো হয়, মিসর থেকে ইজিপ্ট এয়ারক্রাফটের যে দুটি বিমান ভাড়া করা হয়েছিল তার একটিকে ইতোমধ্যে ফেরত দেওয়া হয়েছে। বাকি অন্য বিমানটিও ফেরত দেওয়ার প্রক্রিয়াধীন। মিসর থেকে ত্রুটিপূর্ণ বিমান ভাড়া করার ক্ষেত্রে যে অসম চুক্তি করা হয়েছিল, সেটি খতিয়ে দেখার জন্য মন্ত্রণালয়কে পরামর্শ দেয় কমিটি। পাশাপাশি যারা ওই চুক্তির সঙ্গে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলা হয়েছে।
একই সঙ্গে পরবর্তী সময়ে বিমানের কোনো বড় ধরনের চুক্তি বা ক্রয় সংক্রান্ত বিষয় হলে কমিটিকে অবহিত করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। কমিটি সূত্র জানায়, বৈঠকে বিগত দশ বছরে বিমানের কী কী যন্ত্রাংশ ক্রয় করা হয়েছে তার পূর্ণাঙ্গ তালিকা পরবর্তী বৈঠকে উপস্থাপন করার সুপারিশ করা হয়েছে। এ ছাড়া মুজিববর্ষ উপলক্ষে ২০২০ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত প্রত্যেক মাসের ১৭ তারিখে অনলাইনে টিকিট ক্রয়ের ক্ষেত্রে প্রথম ১৭ জনকে ১৭ শতাংশ মূল্য ছাড় দেওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সূত্র আরও জানায়, বৈঠকে আলোচনা শেষে পর্যটন শিল্পকে আরও বেশি আকর্ষণীয় করার জন্য একটি সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা গ্রহণের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।